সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা অভাবনীয় উন্নতি করেছি। আর এর সাথে সাথে আমাদের দরকার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা যাতে করে দেশের উন্নয়নে শিক্ষার্থীদের অবদান নিশ্চিত করা যায়। আর এ সকল বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই বিওয়াইএলসি স্যোশাল এর মাসিক আলোচনা অনুষ্ঠানের এবারের বিষয় ছিল “শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা ও তা থেকে উত্তোরনের উপায়”। এটি অনুষ্ঠিত হয় বিওয়াইএলসি হেডকোয়ার্টারে আর সঞ্চালনা করেন বিওয়াইএলসি মার্কেটিং এন্ড আউটরিচ বিভাগের নির্বাহী, আহমেদ সাব্বির।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সফল ৫ জন বিওয়াইএলসি গ্র্যাজুয়েট। আলোচনা থেকে উঠে আসে, সবার আগে যে ব্যাপার টা নিশ্চিত করতে হবে তা হচ্ছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমান সুযোগ সুবিধা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যেন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমান সুযোগ সুবিধা পায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভেদে এক ই লেভেলের শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকে, অর্থাৎ কেউ ভালো সুযোগ পায় তো কেউ অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হয় যা কখনও কাম্য নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরা যাক, সেখানে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাবের সুযোগ সুবিধা অপ্রতুল। যে কারনে তাদের ব্যবহারিক শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চাইলেও তারা হয়তো বিভিন্ন গবেষণা করতে পারছে না। অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। অথচ এই সময়টা হচ্ছে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সব চেয়ে মূল্যবান সময়। এখানে শিক্ষার্থীরা যে ধরনের জ্ঞান লাভ করবে তার মাধ্যমেই তারা ভবিষ্যৎ গড়বে।
এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল হাসান বলেন, “দক্ষতার অভাবে চাকরির সুযোগ না পাওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মাঝে একটা হতাশা কাজ করে।” যে ধরনের গবেষণা বা কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাবে সে জায়গাতেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রিসোর্স এর অভাব রয়েছে। অর্থাৎ এক ই ডিগ্রিধারীদের মধ্যে কেউ ভালো দক্ষতা নিয়ে বের হচ্ছে এবং কারো কারো দক্ষতার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে চাকরি পেতে বা নিজের জ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই নিজের প্রচেষ্টায় অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে তাদের একাডেমিক বিষয়ের বাইরে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়ছে যদিও তার সংখ্যা খুব ই নগণ্য। কিন্তু এতে করে শিক্ষার সামগ্রিক উদ্দ্যেশ্য বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
এক ই ভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করা যায় নি। যে কারনে এক ই কারিকুলামে পড়াশোনা করার পরেও তাদের মাঝে একটা “গ্যাপ” থেকে যায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সব শিক্ষা উপকরন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি। তারা পর্যাপ্ত শিক্ষক পাচ্ছে না বা অনেক সময় সব বিষয়ের শিক্ষক পাচ্ছে না। অর্থাৎ শিক্ষার মূল ভিত প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। সবার আগে তাই সব পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তাছাড়া বর্তমানে চাকরির যোগ্যতা হিসেবে বিভিন্ন দক্ষতা চাওয়া হয় যা শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থায় লাভ করতে পারে না। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের বাইরেও আরও অনেক দক্ষতা প্রয়োজন যেগুলো সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব বেশি সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু পরবর্তীতে ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে তারা বাঁধার সম্মুখীন হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে কমিউনিকেশন স্কিল এর কথা। অনেক শিক্ষার্থী জানে না কিভাবে সঠিক পন্থায় কারো সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তার কমফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে না। এক ই রকম আরও কিছু সফট স্কিলস এর দরকার যা সব ধরনের জব বা উদ্যোক্তা হতে গেলে প্রয়োজন যা শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা যায় না।
আরেকটি ব্যাপার পরিলক্ষনীয় আর তা হচ্ছে, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় সৃজনশীলতা চর্চার অভাব। যদিও বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে, শিক্ষার্থীরা এখনও মুখস্থ বিদ্যার আবর্ত থেকে বের হতে পারছে না। এর পিছনে প্রধান কারন হচ্ছে শুধুমাত্র ফলাফল কেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা। এ ব্যাপারে বিওয়াইএলসি কারিকুলাম বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার ও ইনস্ট্রাক্টর আলমীর আহসান আসীফ বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীদের কে সৃজনশীলতার ব্যাপারে আরও আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাদের মাঝে কৌতূহল তৈরি করতে হবে যেন তাদের মাঝে নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ে”। এছাড়াও তিনি পরামর্শ দেন অভিভাবকগণ যেন শিক্ষার্থীদের সামনে কোন আইডল সেট করে না দেয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়, তারা শুধুই ফলাফলের ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে করে শিক্ষার মূল উদ্দ্যেশ্য নষ্ট হচ্ছে অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের চেয়ে একটি ভালো ফলাফল ই মুখ্য হয়ে উঠছে। ভালো ফলাফলের পাশাপাশি দক্ষতার ব্যাপারেও সমান গুরুত্ব দেয়া উচিত। আর তা সম্ভব হয় যখন ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃজনশীলতার চর্চা করানো হয়। এ ব্যাপারে জামিয়া রহমান তিসা বলেন, “আমি এমন একটি স্কুলে পড়াশোনা করেছি যেখানে অনেক বেশি সৃজনশীল কাজ করতে হয়েছে। আমার মনে হয় আমাদের কারিকুলাম টা এমন ই হওয়া উচিত”।
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, শুধু ফলাফলের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারনে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মনে ধীরে ধীরে ধারণা জন্মায় তাদের শুধু একটা ভালো ফলাফল হলেই চলবে। আর এ কারনে তাদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
উক্ত আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার আর তা হচ্ছে, সবার সমন্বিত উদ্যোগ ই শিক্ষার্থীদের কে বর্তমান বিশ্বের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষানীতির সঠিক বাস্তবায়ন ও জরুরি। আলোচনায় বক্তারা এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেন। অভিভাকদের কে উপলব্ধি করতে হবে কেন শিক্ষার্থীদের উপরে কড়াকড়ি আরোপ না করে তাদের কে সঠিক শিক্ষা ও সৃজনশীল কাজের জন্য আগ্রহী করে তুলতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালবাসা ও স্নেহ পেলেই বরং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগী হয়ে উঠবে।

সত্যিই, এই ফলাফল-কেন্দ্রিকতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসাটা এখন খুব জরুরি।