নেতৃত্ব শিক্ষার সময় যে প্রশ্নটির মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হতে হয় তা হল অথোরিটি বা ক্ষমতা ছাড়া নেতৃত্ব চর্চা করা সহজ নাকি ক্ষমতা থাকলে নেতৃত্ব চর্চা করা সহজ? এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোন উত্তর নেই। স্থান, কাল ও অবস্থা ভেদে এর উত্তর একেক রকম। তবে এর উত্তরের মধ্যে অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান ঠিকই রয়েছে।
বাংলাদেশে আমাদের যে সকল সমস্যা তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সমস্যা তৈরি ও সমাধানের অন্তরায় আমরা নিজেরাই। এবং এ কাজে আমাদের সবচেয়ে প্রচলিত অজুহাত আমার তো এই সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা নেই কিংবা দায়িত্ব যাদের তারা তো কিছু করে না। এই অজুহাত থেকে আমরা চাইলেও অনেক সময় সহজে বের হয়ে আসতে পারি না।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ খেলাধুলার আসর চলছে রাশিয়া তে। ফুটবল বিশ্বকাপ। আর কোন খেলার আসর নিয়ে বিশ্বে বিশেষত বাংলাদেশে এরচেয়ে বেশি মাতামাতি হয় কিনা আমার জানা নেই। গত রাতেই অন্যতম পরাশক্তি আর্জেন্টিনা ও পর্তুগাল বাদ পরেছে দ্বিতীয় পর্ব থেকে। খেলা দেখতে দেখতেই মনে হল আরে এখানেই তো আছে সেই প্রশ্নের খুব সহজ একটা উত্তর।
এবারের বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব থেকেই অনেকটাই অগোছালো দল আর্জেন্টিনা। অনেকটা ধরেই নেয়া গিয়েছিল বেশিদূর যেতে পারবে না সাম্পাওলির দল। বাদও পরেছে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব থেকে যে বাদ পড়লো সেটি কি আসলেই দল আর্জেন্টিনা? নাকি ফুটবলের জাদুকর লিওনেল মেসি?
একটু ভালোভাবে দেখলে দেখা যাবে দল হিসেবে আর্জেন্টিনা তো সেই বাছাই পর্বেই বাদ পরে গিয়েছিল। এতদিন যে টিকে ছিল তা দলের বিশাল বড় ব্যনারের নিচে সেই জাদুকর। যত না বেশি সমর্থক দলের তার থেকে বেশি সমর্থক মেসির। তার জন্যই যেন বিশ্বকাপ জিততে চায় তার সমর্থনের বিশ্ব।
অনেকটা একই অবস্থা সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। এখানেও দল যেন প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর একটা নিয়ম মাত্র। এই নিয়ম বাদ গেলে খেলতে হত তাদের একারই।
দুজনই আবার দলের অধিনায়ক। তাদের দিকে এমনিতেই এত আলো তার উপর অধিনায়কের ভার যেন মাঠ থেকে এক মুহূর্ত আড়াল হওয়ার সুযোগ নেই তাদের। তারা দুজন যে বর্তমান বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় তাতে কারো সন্দেহের সুযোগ নেই। কিন্তু এই বিশ্বকাপে দলকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে নেতৃত্ব চর্চা করতে হত তাতে তারা ব্যর্থ।
অনেকটাই মেসি কে কেন্দ্র করে এমন ৫টি কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি যা আমাদের নিজেদের নেতৃত্ব চর্চার ক্ষেত্রেও অনেকটাই বাধা।
১। ওয়ার্ক অ্যাট দ্যা সেন্টারঃ
আমরা জানি নেতৃত্ব চর্চা করতে হলে অংশগ্রহণকারী কিংবা জড়িত সকলের সাথে সম্পর্কিত একটি কাজ খুঁজে বের করতে হয় যাকে আমরা ‘ওয়ার্ক অ্যাট দ্যা সেন্টার’ বলি। আমাদের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা যে সকলের প্রধান মনোযোগ যেন মাঝের এই কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হয়। তার জন্য যার যার অবস্থান থেকে সবাই চেষ্টা করে যায়।
কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আমরা যে ভুলটি করি তা হল মাঝখানে ঐ কাজটির বদলে আমরা নিজেরা চলে আসি। তখন জড়িত সকলের মনোযোগ কাজের বদলে ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তি উপরে পরে। তখন না ঐ কাজটি সামনের দিকে আগায়, না আমরা আমাদের সাধ্য মত ঐ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারি।
আর্জেন্টিনা দলটিকে দেখলে বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। যেখানে দলের সাথে জড়িত সবার মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু হওয়া দরকার ছিল বিশ্বকাপ জেতা এবং সে লক্ষ্যে সবাই এক সাথে কাজ করা। কিন্তু মেসির মত তারকা থাকায় ঐ কাজের বদলে দলের কেন্দ্রবিন্দু সে নিজেই পরিণত হয়েছে। যার কারণে না মেসি তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে খেলতে পেরেছে না দল তাদের মুল কাজের উপর মনোযোগ দিতে পেরেছে।
২। সমন্বয়হীনতাঃ
একটা দল হিসেবে কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ভালো হতে হয়। দলের মধ্যে বিশ্বস্ততা থাকতে হয়, জানতে হয় কে কখন কি ভূমিকা পালন করতে পারে। মেসি দলের কেন্দ্রবিন্দু পরিণত হওয়ায় তার সাথে সখ্যতা না থাকায় দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাজ করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নাইজেরিয়ার সাথে খেলায় আর্জেন্টিনা দলের সাফল্যের পেছনে মেসি আর বানেগার যে সমন্বয় তা অন্যতম প্রধাণ ভূমিকা পালন করেছে। এমন বিশ্বস্ত সমন্বয় তাদের আগের এবং পরের খেলায় চোখে পরে নি। এখানে যদি দলের কেন্দ্র বিন্দু মেসি না হয়ে বিশ্বকাপ জেতাতেই সবার মনোযোগ থাকত তাহলে যার যার জায়গায় সবাই বিশ্বস্ত ভূমিকা পালন করতে পারতো।
৩। টিম ওয়ার্কঃ
বিশিষ্ট মনস্তত্ত্বিক ডেভিড কান্টর’র ফোর প্লেয়ার মডেলে তিনি বলেছেন দলের মধ্যে সঠিকভাবে নেতৃত্ব চর্চা করতে হলে দলের সবাইকে প্রয়োজন ও সময় সাপেক্ষে চার ধরণের ভূমিকা পালন করতে হয়। দলের মানুষজনকে কখনো বুদ্ধি দিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, আবার কখনো অন্যের বুদ্ধির যৌক্তিক বিরোধিতা করতে হয়। পাশাপাশি বুদ্ধি বাস্ত্যবায়নের জন্য কাজ করতে হয় ওপর দিকে কখনো কখনো কোন কাজ না করে দাঁড়িয়ে দেখতে হয় কারণ এতে দূর থেকে দেখা যায় যে কোথায় কিসের ঘাটতি আছে। আর্জেন্টিনা দলে এই মডেলের বাস্তবায়ন ছিল না বললেই চলে। কেউই নিজের নির্ধারিত ভূমিকার বাইরে এসে অন্য কোন ভাবেই দলের কাজকে সামনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে নি।
৪। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাঃ
একটা দলে যার হাতে ক্ষমতা থাকে তাকে আমরা অথোরিটি বলি, বাংলায় কর্তৃপক্ষ। দলের নেতৃত্ব চর্চা কিংবা সমস্যা সমাধানে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলে এই কর্তৃপক্ষের কাজ হল দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করা, দলকে দিক নির্দেশনা দেয়া এবং বিপদ থেকে রক্ষা করা। যখন সে এই তিন ধরণের কাজ করতে ব্যর্থ হয় তখন দলের কাজও সামনের দিকে আগায় না। আর্জেন্টিনা দলেও তাদের কোচ সাম্পাওলি তার জন্য নির্ধারিত এই তিন ধরণের কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই পুরো দল হিসেবে তারা উঠে দাঁড়াতে পারে নি। দলের শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সাফল্যের জন্য দিক নির্দেশনা দেয়া এবং হেরে বাদ পড়ার মত বিপদের সমাধান তার কাছে ছিল না। কোচ হিসেবে তার কাছে সমাধান না থাকায় এবং সমস্যা সমাধানে তার উপর সকলের অত্যধিক নির্ভরশীলতার কারণে দলের অন্য কেউ কোন ভালো সমাধান নিয়ে দলের জন্য এগিয়ে আসতে পারে নি। সঠিক ভাবে নেতৃত্ব চর্চার জন্য কর্তৃপক্ষের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে সফল হতে হলে দুটি কঠিন কাজ করতে হবে। কর্তৃপক্ষের যেমন সবাইকে বলতে হবে যে ‘এই কাজ আমাদের সবার, আমার কাছে এই সমস্যার সমাধান নেই এবং আমাদের সবাইকে মিলেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে’ তেমনি দলে থাকা বাকিদেরও এগিয়ে আসতে হবে যার যার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে আসন্ন অজানা বিপদ থেকে দলকে উদ্ধার করতে।
আর্জেন্টিনা যেমনি ভাবে ভালো দল, তেমনই ভাবে বাংলাদেশও অপার সম্ভাবনার। আপাত দৃষ্টিতে আমরা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ ও জয়ের স্বপ্ন না দেখলেও এই তরুণরাই বাংলাদেশের বিশ্ব জয়ের নেতৃত্ব দিবে তা অনিবার্য। আর সেই অনিবার্য নেতৃত্বের জন্য তরুণদের কে হতে হবে প্রশিক্ষিত, দক্ষ এবং যোগ্য। নেতৃত্ব চর্চার জন্য তারা যেন সকল বাধা কাটিয়ে উঠে এবং অনুপ্রাণিত হয় সেদিকে দৃষ্টি প্রদান করার প্রয়োজন অত্যধিক। কারণ সফলতা কেউ প্রাপ্য না, সফলতা অর্জন করতে হয়। মেসি পারে নি বিশ্বকাপ অর্জন করতে, কিন্তু বিশ্বাস রাখলে আমাদের তরুণরা পারবে বিশ্ব জয় করতে।
Leave a Reply