পিরিয়ড বা মাসিক শব্দটি নিয়ে খুব একটা খোলামেলাভাবে কথা বলতে আমরা অস্বস্তিবোধ করি। অথচ আর দশটা শারীরবৃত্তীয় ব্যাপারের মতই এটা ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মে। একজন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের সুস্থতা জড়িয়ে আছে মাসিক (ঋতুস্রাব)সময়কালীন যত্নের সাথে। এই সময়টুকুর অবহেলা ডেকে আনতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুকি। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাসিক একটি উপেক্ষিত বিষয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ‘গোপন’ বা ‘লজ্জাজনক’। এ নিয়ে মানুষের বিশেষ করে নারীদের মাঝে রয়েছে অসংখ্য কুসংস্কার আর ভুল ধারণা। এই ভুল ধারণা আর না বলা কথাগুলোকে সবার সামনে তুলে ধরতে এবং সর্বস্তরে বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদেরদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাজ করছে ক্যাম্পেইন রেড। কথা বলেছিলাম ক্যাম্পেইন রেড টিম এর একজন সদস্য সৈয়দা ফারজানা আহমেদের সাথে।
২০১০ সালে চট্টগ্রামে আয়োজিত বিল্ডিং ব্রিজেস থ্রু লিডারশীপ ট্রেইনিং(বিবিএলটি) প্রোগ্রামে ক্যাম্পেইন রেড এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের পরিচয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এর শিক্ষার্থী রুবিনা আক্তার এবং রিমু বৈদ্য এসেছিলেন বাংলা মাধ্যম থেকে আর বাকি দুই সদস্য আনোয়ার আহমাদ, মুরশেদুল আলম এসেছিলেন মাদ্রাসা মাধ্যম থেকে। ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমের মানুষজন একসাথে হলে যে সত্যিই দারুণ কিছু করা সম্ভব তার উজ্জল উদাহরণ ক্যাম্পেইন রেড। ‘বিওয়াইএলসি ইয়ুথ লিডারশীপ প্রাইজ ২০১৬’ বিজয়ী সেরা ১০ টি প্রজেক্টের মধ্যে ক্যাম্পেইন রেড একটি। প্রজেক্ট শুরু করার জন্য সিড ফান্ডিং হিসেবে পাওয়া ১০,০০০ ইউএস ডলার নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন ক্যাম্পেইন রেড এর যোদ্ধারা। মূল ধারনা টি এসেছিল বিবিএলটি গ্রাজুয়েট রুবিনা আক্তার এবং রিমু বৈদ্যর কাছ থেকে এবং পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগ দেন আনোয়ার আহমাদ, মুরশেদুল আলম এবং সৈয়দা ফারজানা আহমেদ।
তাদের লক্ষ্য ছিল মাসিক ব্যবস্থাপনা এবং মাসিক নিয়ে সমাজে যেসব প্রাচীন ধ্যান-ধারনা বা প্রথা নারী ও কিশোরীদের বিদ্যালয়ে বা কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলে তার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে কাজ করা। পাশাপাশি, ছেলেদের ও এই ব্যাপারে ধারনা দেয়া যাতে তারা মাসিকের গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং তাদের মা, বোন এবং স্ত্রীর প্রতি আরও যত্নশীল হতে পারে।
প্রাথমিক ভাবে কাজ শুরু হয়েছিলো কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এক উপজেলা উখিয়ার ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দুর্গম সেই উখিয়াতে ক্যাম্পেইন রেড কাজ করেছে বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায়। আর শুধু ছাত্রীরা নয় বরং ছাত্ররাও অংশ নিয়েছে সচেতনতামূলক এই কার্যক্রমে। ফারজানা জানালেন, “মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এই প্রোগ্রামের আওতায় আনাটা আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো। কিন্তু শিক্ষকদের সাথে কথা বলে আমরা তাদের মাসিক এবং এই সম্পর্কিত সচেতনতার গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হই। পরবর্তীতে তারা আমাদের আন্তরিক সাহায্য এবং উৎসাহ জুগিয়েছেন”।
গত এক বছরে ক্যাম্পেইন রেডের কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এখানে উল্লেখ করতে হয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৫২ জনের বেশি শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্যাম্পেইন রেডের লক্ষ্যটিকে সামনে এগিয়ে নিতে অক্লান্ত ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ক্যাম্পেইন রেড টিম তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের মাসিক ব্যবসথাপনা, ছাড়াও কিভাবে ক্লাসরুমে ছাত্র-ছাত্রীদের লজ্জাকে দূরে সরিয়ে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, এ ব্যাপারে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পেইন রেড স্বেচ্ছাসেবকরা মাসিককালীন স্বাস্থ্য এবং এ সম্পর্কিত সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, স্কুল এবং মাদাসায় সরবরাহ করা হয়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিন। এছাড়াও, তাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ফেসবুক পেজ যার মাধ্যমে অনলাইনেও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। নারীর মাসিক কালীন সময়কে নিরাপদ করতে কাম্পেইন রেড এর এই উদ্যোগ উখিয়াতে যেমন সাড়া পেয়েছে তেমনি সমাজের নানা স্তরের মানুষের কাছে ও গুরুত্ব পাচ্ছে।
ফারজানা জানালেন, আমাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আমরা ক্যাম্পেইন রেডকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবছর বিওয়াইএলসির পক্ষ থেকে ১৬,০০০ ইউএস ডলার পেয়েছি। আমরা ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের রাউজান এবং পটিয়া উপজেলাতে বড় পরিসরে কাজ শুরু করতে চাই। স্কুল গুলোতে স্বল্পমূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করার কথাও ভাবছি। পরিকল্পনা আছে গ্রামের নারীদের স্বল্পখরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি শেখানোর মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা।
ক্যাম্পেইন রেড স্বপ্ন দেখে একদিন মাসিক শব্দটাকে কেউ আর ট্যাবু হিসেবে ভাববে না। নিশ্চিত হবে একটি নিরাপদ, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ যেখানে নারীর প্রতিটি পদক্ষেপ হবে আরো দৃঢ় আর আত্মবিশ্বাসী। ক্যাম্পেইন রেড এর এই দারুণ উদ্যোগ এগিয়ে যাক বহুদূর। ভাঙ্গুক কুসংস্কার আর অসচেতনতার বেড়াজাল।
Leave a Reply